নগরী ঢাকা – ২

ঢাকাতে বিভিন্ন সময়ে সরকারী বা বেসরকারী উদ্যোগে বেশ কিছু আবাসিক এলাকা ডিভেলপ করা হয়েছে। যেমন ধানমন্ডি , গুলশান, নিকেতন , পল্লবী, বনশ্রী , বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা বা বিভিন্ন ডিওএইচএস। সবগুলোই প্লট ভিত্তিক অর্গানাইজেশন। অর্থাৎ একটা বেসিক রোড নেটওয়ার্কের আওতায় কোনো এলাকাকে প্রথমেই ছোট ছোট ব্লকে ভাগ ক’রে নিয়ে তাতে চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন আকার এবং আয়তনের প্লট তৈরী করা হয়। তারপর সেই প্লটগুলোকে এক বা একাধিক মালিকানায় হস্তান্তর করা হয়।

প্লট ভিত্তিক এই ‘এরিয়া ডিভেলপমেন্টের’ ধারণা আমাদের দেশে বেশ জনপ্রিয়। কারণ প্লট বুঝে পাওয়ার পর সেখানে ইচ্ছামাফিক বিল্ডিং বানিয়ে নেওয়া যায়। ‘ঢাকা ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ২০০৮’ অনুযায়ী যদিও একাধিক প্লট একত্রিত করার সুযোগ আছে তবুও তেমনটা করতে খুব কমই দেখা যায়। ঢাকার বেশিরভাগ ভূমি-মালিক নিজ নিজ প্লটে আলাদা আলাদা বিল্ডিং নিজ উদ্যোগে অথবা বিভিন্ন ডিভেলপার প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে বানিয়ে নেন। যদিও ২০০৮ এর রাজউকের ইমারত নির্মাণ বিধিমালা মেনে বিল্ডিং বা ইমারত তৈরী করেন খুব কম লোক/ ডিভেলপার প্রতিষ্ঠান। তারপরও রাজউক আর নানা ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান প্লটভিত্তিক একই ধরণের আরো প্রকল্প শুরু করছে এবং বাস্তবায়ন করছে। নতুন প্রকল্প শুরু করার আগে একই ধরণের পুরোনো প্রকল্পগুলোর মূল্যায়ন করা হচ্ছে না বললেই চলে।

প্লটভিত্তিক প্রকল্পগুলো মূলত আবাসিক। হয়তো বড় কোনো প্রকল্পে কিছু অনাবাসিক বা অন্যান্য ব্যবহারের জন্য কিছু কিছু প্লট রাখা হচ্ছে। সেও আবাসিক প্লটগুলোকে সার্ভিস দেওয়ার কথা ভেবে নয়তো বিশেষ কোনো বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে। সামগ্রিক নগর পরিকল্পনাকে মাথায় রেখে সেগুলো করা হচ্ছে ব’লে মনে হয় না।

চাহিদা বিবেচনা করে ঢাকাতে আবাসিক ব্যবহারের জন্য সাধারণত ২.৫, ৩, ৫, ৭.৫, ১০ এবং ২০ কাঠার প্লট তৈরী করা হয়। প্লটগুলো কমপক্ষে ২৫ ফুট চওড়া রাস্তার সাথে সংযুক্ত থাকা বাঞ্ছনীয় ২০০৪ এর বেসরকারী ভূমি উন্নয়ন বিধিমালা মোতাবেক। এতে ক’রে ঢাকার আবাসিক এলাকাগুলোতে বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য তৈরী হচ্ছে। যেমন –

১. বারবার ফুটপাথ ভেঙে যাচ্ছে। ৩০ থেকে ৭০ ফুট পরপর প্লটে ঢোকার জন্য গেইট বা ফটক বানাতে হচ্ছে। আর প্রতিটা ফটকের সামনে থেকে ভেঙে ফেলতে হচ্ছে ফুটপাথের ধারাবাহিকতা। যার ফলে প্লটে বসবাস করা মানুষগুলোর পক্ষেও ফুটপাথগুলো ব্যবহার করা সুবিধাজনক থাকছে না। আর প্লটগুলোর ধার ঘেষে হাঁটাহাঁটি না ক’রতে পারার জন্য দীর্ঘ সময় পাশাপাশি বাস করেও অনেকেই অপরিচিত থাকছেন। আবার হাঁটাহাঁটির স্বাভাবিক আগ্রহটাও নষ্ট হ’য়ে যাচ্ছে হাঁটাকে উপভোগ করতে না পারার জন্য।

২. ঠিক কতগুলো প্লট বা ফ্লাটের জন্য কী পরিমাণ জমি খেলার মাঠ, পার্ক বা খোলা জায়গা হিসেবে থাকা দরকার, ঢাকা আর অন্য বড় শহরগুলোর জন্য বা নিদেন পক্ষে বাংলাদেশের জন্য, তা নিয়ে বিশেষ ভাবনা-চিন্তা আমাদের হাউজিং কোডগুলোতে নেই। একটা বড় এলাকার জমির পরিমাণের উপর নির্ভর ক’রে মাঠ আর পার্কের ব্যবস্থা করাটা অযৌক্তিক। বরং মাঠের সংস্থানের জন্য মূল বিবেচনা হওয়া দরকার হাউজিঙের ধরণ এবং তার জনঘনত্ব। বাস্তবক্ষেত্রে যেটা হচ্ছে সেটা একধরণের প্রতারণাও। হয়তো হাউজিঙের লে-আউট পাস করিয়ে আনার জন্য একটা নকশা করা হয়, যে নকশাতে কিছু পরিমাণ জমি মাঠ বা পার্ক হিসেবে দেখানো হয়। অথচ প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় সেগুলোর অনেকগুলোই বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। এর ফলে হাউজিংগুলোতে বাস করতে থাকা মানুষগুলোর জন্য খোলামেলা প্রাকৃতিক পরিবেশ থাকছে না যেখানে পরষ্পরের সাথে সহজে মেলামেশা করা যায়। এতে মানুষের স্বাভাবিক শেয়ারিঙের আকাঙ্ক্ষাটা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
আবার মানুষের একটা প্রবণতা হ’লো সে সবাইকে সব কিছু বলে না। একজন মানুষ নিজেকে প্রকাশ করে বেশ ভাবনা-চিন্তা ক’রে নির্বাচিত কিছু মানুষের কাছেই মাত্র। আর তাই এমন একটা পরিবেশ দরকার যেখানে এই মানুষগুলোকে খুঁজে নেওয়া যাবে। দেশের প্লট-কেন্দ্রিক হাউজিংগুলোতে সেই সুযোগ একেবারেই থাকছে না পর্যাপ্ত মাঠ, পার্ক বা কমন-স্পেসের অভাবে।

৩. প্লটগুলো ছোট ছোট হওয়ায় তার সংখ্যাও বেশি হচ্ছে। আর প্রতিটা প্লটের জন্য আলাদা আলাদা ক’রে বিভিন্ন সার্ভিসের জন্য আবেদন ক’রতে সামগ্রিকভাবে বেশ বড় একটা সময় আর লোকবলের অপচয়ও হচ্ছে। আবার প্লটগুলোর মালিকেরা সবাই যে একই সাথে ভবন তৈরী করেন বা করতে পারেন তাও নয়। ফলে নানা সময় বিভিন্ন সার্ভিস লাইনের সাথে প্লটগুলোর সংযোগ তৈরী করতে হওয়ায় পানি বা গ্যাসের লাইনের জন্য বারবার হাউজিঙের রাস্তায় কাটাকাটির দরকার পড়ছে। আমাদের সার্ভিস দেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোতে দক্ষ লোকবল আর পর্যাপ্ত অর্থবল দুইয়েরই কমতি আছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ভেতরে সমন্বয়েরও অভাব আছে। আর তাই একবার কাটাকাটি হ’লে সেই রাস্তা ঠিক হ’তে সময় লেগে যায় অনেক।
অথচ প্লটগুলো যদি বড় বড় আকারে করা যেতো, ধরা যাক ৫ একর বা ১০ একর, তাহলে বারবার সার্ভিস লাইনের জন্য দৌড়াতেও হ’তো না, বারবার ক’রে রাস্তা কাটাকাটিও করতে হ’তো না। ফুটপাথ বারবার ভেঙে যাওয়ার যে ব্যাপারটা আগে বলা হলো সেটাও কমে আসতো।

৪. বেসরকারী হাউজিঙের কোড বা বিধি ব’লছে প্রতিটা প্লটের সামনে ন্যুনতম ২৫ ফুট চওড়ার রাস্তা থাকতে হবে। এই পরিমাণ চাওড়া একটা রাস্তার সাথে যখন আমরা ৫৪ ফুট বা ৭০ ফুট গভীরতার প্লট বানাচ্ছি তখন ব্যবহৃত জমির অনুপাতে রাস্তার পরিমাণ বেশ বেড়ে যাচ্ছে। অমি অনেকগুলো হাউজিঙে গিয়ে দেখেছি এই ধরণের রাস্তাগুলোতে গাড়ি বা মানুষের ভিড় বেশ কমই থাকে। উত্তরা বা বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার মূল রাস্তাগুলো বেশ ব্যস্ত হ’লেও প্লটগুলোর সামনের রাস্তাতে তেমন একটা ভিড় দেখা যায় না। এই রাস্তাগুলোকে যদি ৫ একর বা ১০ একরের হাউজিঙের অংশ ক’রে নেওয়া যেতো তাহলেও বেশ একটা সামাজিক-পরিসর গ’ড়ে উঠতো। আবার এমন ধরণের রোড-নেটওয়ার্কের জন্য অনেকগুলো নোডও তৈরী হচ্ছে। ফলে বাড়ছে ক্রসিঙের সংখ্যা, যা যানজট তৈরীর অন্যতম প্রধান কারণ।

৫. ছোট প্লটে সাধারণত বেশি উঁচু ভবন (৭ তলার অধিক) বানানো বেশ কঠিন। আবার বড় প্লটের সাপেক্ষে ছোট প্লটে বহুতল ভবন নির্মাণ করতে বাড়তি খরচ পড়ে যায়। যেমন ৩ কাঠা জমির একটা ৭ তলা ভবনে যার প্রতিতলাতে একটি ক’রে এ্যাপর্টমেন্ট বা মহল আছে তার জন্য ন্যুনতম একটি সিঁড়ি ও একটি লিফ্ট দরকার পড়ে। একই সংখ্যক সিঁড়ি আর লিফ্ট দিয়ে প্রতিতলায় অন্তত ৪ টি মহল আছে এমন ৭ তলা ভবনকে সার্ভিস দেওয়া যায় অনায়াসেই। ৩ কাঠার চারটি প্লটকে একত্রিত ক’রে ১২ কাঠার একটি প্লট বানানো গেলে একই পরিমাণ জমিতে একই সুবিধা সম্বলিত ২৪টি মহল নির্মাণ করা যাবে ৩টি সিঁড়ি আর ৩টি লিফ্ট কম বানিয়েও। অবশ্য চাইলে অধিক উপযোগীতার জন্য একটি লিফ্ট বেশি বানানো যায়। ৩টি সিঁড়ি আর ২/৩টি লিফটের জন্য যে জায়গা লাগে সেই পরিমাণ জায়গা জমিতে উন্মুক্ত রেখে দেওয়া যেতে পারে ভবনের ব্যবহারকারীদের খেলার মাঠ হিসেবে। সেখানে কিছু ফলের গাছও লাগানো যেতে পারে। বাড়তি পরিমাণ জমি উন্মুক্ত থাকার কারণে তা বৃষ্টির পানি শোষণের জন্যও অধিক উপযোগী হ’তো।
১০ তলার অধিক উঁচু বিল্ডিঙের জন্য যে ধরণের সেট-ব্যাক বিধিমতে দরকার হয় সেটা ছাড়লে ছোট প্লটে ১০ তলার অধিক উঁচু ভবন বানানো আরো কঠিন হ’য়ে পড়ে। আবার ভবনের এরিয়া বেড়ে গেলে বেশি পরিমাণে পার্কিঙের জায়গা লাগে। যান্ত্রিক পার্কিং পাতালঘরে (বেইজমেন্ট) করাটাই নানা বিচারে ভালো আর সুবিধাজনকও। কিন্তু ছোট প্লটের ক্ষেত্রে সুবিধাজনক পাতালঘর বানিয়ে নেওয়াটা বেশ কঠিন, অনেক ক্ষেত্রে অসম্ভবও। বেশি পরিমাণ রিটেইনিং-দেয়াল (মাটি আটকে রাখার জন্য পাতালঘরের চারপাশে যে দেয়াল তৈরী করা হয়) দরকার পড়ে ছোট প্লটগুলোতে বেইজমেন্ট বা পাতালঘর তৈরীর জন্য। র‍্যাম্প ব্যবহার ক’রে পার্কিঙের জন্য পাতালঘর তৈরী করতে হ’লে প্লটের আকার ৭.৫ কাঠার কম হ’লে কার্যত কোনো সুবিধাই পাওয়া যায় না।

৬. প্রতিটা প্লটকে আলাদা করা আর সেগুলোকে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য বানাতে হচ্ছে সীমানা-দেয়াল। এই সীমানা-দেয়ালের বৃদ্ধিও কম শংকার নয়। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে খরচের পরিমাণও যায় বেড়ে। প্রয়োজন পড়ে অধিক সংখ্যক নিরাপত্তা-প্রহরী।

আবার বড় আকারের প্লটের সমন্বয়ে হাউজিং বা অন্য কোনো কমপ্লেক্স ক’রলে তার চারপাশে প্রাচীর তুলে দিতে হয় নিরাপত্তার প্রয়োজনে। এই প্রাচীর পরবর্তীতে হ’য়ে দাঁড়ায় রুচিহীন পুরুষদের প্রস্রাব করার উপযুক্ত স্থান। দেশে বিভিন্ন সময়ে গড়ে ওঠা সরকারী আবাসিক কলোনীগুলোর অভিজ্ঞতা থেকে আমরা এটা জানি। আমাদের সামাজিক আচরণের পরিবর্তন না হ’লে নিরবচ্ছিন্ন ফুটপাথ তৈরী করা তাই এক রকম অসম্ভব।

সব মিলিয়ে প্লট-কেন্দ্রিক এই ধরণের আবাসিক এলাকা গড়ে তোলাটা গত কয়েক যুগ ধ’রে অর্থনৈতিক বিবেচনায় বেশ উপযোগী হ’লেও প্রতিবেশ বা পাড়া (কমিউনিটি) তৈরীতে তা যে খুব সফল হয়নি তা বোধহয় এই ২০২১ সালে এসে বলা যায়। এই অবস্থায় আমাদের বর্তমান আবাসিক এলাকাগুলোকে খানিকটা রিএ্যারেঞ্জ বা পুনর্বিন্যাস করা যায় কিনা সেটা আমাদের নগর-পরিকল্পক আর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ খতিয়ে দেখতে পারেন। যেহেতু দেশের অর্থনৈতিক সামর্থ্য দিনেদিনে বাড়ছে সেইহেতু শুধুমাত্র প্লট-কেন্দ্রিক উন্নয়ন ভাবনার দুর্বলতাগুলো নিয়ে এখন আলোচনা করা যায় ব’লেই মনে করি।

পুনশ্চ:
১. ‘প্লট ভিত্তিক অর্গানাইজেশন’ এই কথাটার বাংলা ক’রতে পারলে ভালো লাগতো। কিন্তু প্লট আর অর্গানাইজেশন শব্দদুটো যে অর্থে এখানে ব্যবহার করেছি তার জন্য যথাযত বাংলা শব্দ খুঁজে পাইনি। উৎসাহী পাঠকদের সাহায্য প্রত্যাশা করছি এই শব্দগুলোর বাংলা তৈরীতে।

২. শুধুমাত্র প্লট আর আবাসিক এলাকার ভেতরে আজকের আলোচনাটা সীমাবদ্ধ রাখার চেষ্টা করেছি।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান