ছোট দেবর আহসান হাবিব বিলু সড়ক ও জনপথের প্রকৌশলী। নাবিলার বাপ-চাচাদের ভেতরে বিলুই ছিলো লেখাপড়ায় সবচেয়ে ভালো। দুই মেয়ের লেখা-পড়া নিয়ে কথা বলতে তাই আহসান হাবিবই শহর বানুর মূল ভরসা। তবে সহজে আবার পাওয়াও যায় না ওকে। নানা জায়গায় ঘোরাঘুরির উপর থাকে। আবার চাকরীও ট্রান্সফারের। এখন দিনাজপুরে পোস্টিং। নাবিলার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির খবরটা জানানোর জন্য ফোন দেয় শহরবানু। ফোনটা আহসান হাবিবই ধরে, ‘কেমন আছো ভাবি? তোমাদের কথাই ভাবছিলাম।’‘আর বানিয়ে বানিয়ে ব’লতে হবে না। রানু এই কথা বললেও না হয় বিশ্বাস করতাম। ও তো তাও মাঝে মাঝে ফোনটোন দেয়। তুমি শেষ কবে নিজে থেকে ফোন দিয়েছো বলো তো।’ রানু আহসান হাবিবের স্ত্রী। নওগাঁর মেয়ে। আহসান হাবিব যখন চাকরীর জন্য নওগাঁতে ছিলো তখন ওদের পরিচয় আর পরবর্তীতে বিয়ে।
‘রানু একটু আগে তোমাদের কথাই বলছিলো খাবার টেবিলে। ইকবাল এখনো ক্লাস সিক্সে আর এবার নাবিলা ভার্সিটিতে ভর্তি হবে। পিচ্চিটা কত বড় হ’য়ে গেলো তাই ভাবছিলাম।’
‘ওর কথা বলার জন্যই তোমাকে ফোন দিয়েছি। আজ ভর্তি হ’য়ে এলো। খুলানাতেই ভর্তি হ’লো। সিদ্ধান্তটা কি ঠিক হলো, বিলু?’ মেয়ের ভবিষ্যতের ভাবনা শহর বানুর মনে। নাবিলা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানেও সুযোগ পেয়েছিলো।
‘এটাই ভালো হবে ভাবি। বিবিএ এখনকার সাবজেক্ট। এটাতে চাকরীর সুযোগ দিনদিন বাড়ছে। আর একসময় বাপের ব্যবসা দেখতে হবে না কাউকে! ইলোরা তো বিজ্ঞানে পড়ছে।’
‘কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াটা কি ঠিক হলো? রাজধানী শহর। ওখানে থাকলেও তো অনেক কিছু জানতে পারতো, শিখতে পারতো।’
‘শেখা নিজের কাছে ভাবি। তুমি পিচ্চির উপর ছেড়ে দাও তো।’ আহসান হাবিব অনেক আগে থেকেই নাবিলাকে পিচ্চি ব’লে ডাকে। ‘বড় হ’য়ে গেছে না! তুমি এখন ইলোরার দিকে নজর দাও। আর ওর ক্লাস শুরুর আগে আমাদের এখান থেকে একবার ঘুরে যেতে বলো। ক্লাস শুরুর দেরী আছে না?’
‘এখনো তো ক্লাস শুরুর তারিখ দেয়নি। সারাদিন ব’সে-ব’সে গল্পের বই পড়ে। আর ওর দেখাদেখি ইলোরাও গল্পের বই পড়তে চায়। অথচ ক্লাসের বই নিয়ে বসতেই দেখি না। ব’সতে ব’ললেই ঘুম।’
‘মাত্র তো কলেজ শুরু করলো। প্রেশার শুরু হ’লে দেখো নিজেনিজেই পড়বে।’ ভাবিকে ভরসা দেয় আহসান হাবিব।
‘আমার এটাকে নিয়েই চিন্তা বেশি। নাবিলা তো শক্ত আছে। ইলোরাকে একটু বকাও দেওয়া যায় না। একটা কিছু বললেই কান্নাকাটি শুরু ক’রে দেয়।’ শহর বানুর কথায় আহসান হাবিব না হেসে পারে না। ‘এত হেসো না তো। তোমরা ভাই আছো ভালো একটাকে নিয়ে। আমার দুইটাকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়।’
‘নাবিলা কই? ওকে দাও তো।’
‘ধরো একটু, ডাকছি।’ শহর বানু নাবিলাকে ডেকে ফোনের রিসিভারটা দেয়।
‘হ্যালো, চাচ্চু! কেমন আছো তোমরা?
‘আমরা ভালো। তোর মাকে বলছিলাম ক্লাস শুরুর আগে আমাদের এখান থেকে একটু ঘুরে যেতে। দিনাজপুর শহর তো আগে দেখিসনি তোরা। আমিও আর বেশি দিন এখানে থাকতে পারবো না সম্ভবত। বদলির সময় হ’য়ে এলো।’
‘মা এখন কোথাও যাবে কিনা জানি না। তবে আমরা তিন বন্ধু মিলে কয়েকটা জায়গায় ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনা করছি। দেখি ওদের সাথে কথা ব’লে। তোমার ওখানে ওদেরকে নিয়ে আসলে সমস্যা নেই তো?’
‘আমার কোনো সমস্যা নেই। দেখ তোর মা তোদেরকে একলা ছাড়ে কিনা। আর খুলনা থেকে দিনাজপুর কম দূরও তো না। শহরের ভেতরে বা কাছে রেল-স্টেশন থাকলে সহজে চ’লে আসতে পারতি। পার্বতীপুর স্টেশনে খুলনার ট্রেন আসতে আসতে বেশ রাত হ’য়ে যায়। অবশ্য তোরা আসবি শিওর করলে আমি গাড়ির ব্যবস্থা ক’রে রাখতে পারি তোদের জন্য।’
‘আমরা এখনো পর্যন্ত ঠিক করেছি যশোর আর চুয়াডাঙ্গা যাবো। যুথির দাদাবাড়ি যশোর। আর কলির বড় ভাই চুয়াডাঙ্গাতে আছে এখন। ম্যাজিস্ট্রেট। ওর ভাবির সাথে ওর কথা হয়েছে। আমাদেরকে যেতে ব’লেছে।’
‘ভালো পরিকল্পনা। ক্লাস শুরুর আগে এরকম একটু ঘুরে নে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস শুরুর আগে আমরাও কয়েকজন এমন ঘোরাঘুরি করেছিলাম। মনটা চাঙ্গা হ’য়ে যায়। মার সাথে কথা ব’লে আমাকে জানা। আমি ব্যবস্থা ক’রে রাখবোখন।’
‘থ্যাংক য়ু চাচ্চু।’
শহর বানু যুথি আর কলিকে একদিন বাসায় আসতে বলে। ওদের সাথে কথা বলার পর খানিকটা নিশ্চিন্ত হয়। আবার ভাবনাও হয়। এই বয়সের তিনটা মেয়ে নিজেরা মিলে এতটা লম্বা জার্নি ক’রতে পারবে কিনা তা নিয়ে। রাস্তা-ঘাটের সব জায়গা তো নিরাপদ নয়। স্বামী তরিকুল হাবিব আগে এসব নিয়ে খুব ভাবতো না। নাবিলা ওর খেলার জন্য কলেজের টিমের সাথে আগে যশোর আর নড়াইলে গিয়েছে। মেয়ে ছোট এসব নিয়ে কখনো কিছু বলেনি। কিন্তু আনসার আলী মারা যাওয়ার পর লোকটা আর আগের মতো নেই। সারাদিন কী সব নিয়ে যেন ভাবে। জিজ্ঞেস ক’রলে ঠিক মতো বলেও না। কিংবা ব’লতে পারে না। শহর বানুর মনে হয় ওকে একটু সময় দেওয়া ভালো। নাবিলাও যদি কিছু দিনের জন্য ঘুরতে যায় তো সেই সময়টা স্বামীর সাথে কথা বলার জন্য বাড়তি একটু সুযোগ পাওয়া যাবে।
কিন্তু নাবিলার ঘুরতে যাওয়ার কথা শুনে ইলোরাও ওদের সাথে যেতে চায়। বিশেষ ক’রে দিনাজপুর, ওদের ছোট চাচার বাসায়। কিন্তু নাবিলারা আবার ওকে নেবে না। শহর বানুও চায় না ইলোরা ওদের সাথে যাক। শেষে ইলোরা সবগুলো শহর থেকে ওর জন্য কিছু না কিছু কিনে আনার কথা বলে। নাবিলা রাজি হয়।
পরের সপ্তাহেই রাজশাহীগামী সকালের প্রথম ট্রেন কপতাক্ষ-এক্সপ্রেসে চেপে বসে নাবিলা, যুথি আর কলি। স্টেশনে নাবিলার সাথে ওর বাবা এসেছে। যুথি আর কলির সাথেও বাসা থেকে লোকজন এসেছে। ট্রেন ছাড়তেই নাবিলার মনে হ’তে থাকে ও যেন বড় হ’য়ে গেছে। এখন থেকে ও একলা যে কোনো জায়গাতে যেতে পারবে।
তিন জনের জন্যই অনেক দিন পর ট্রেন-ভ্রমণ। ধীরে ধীরে ট্রেন চ’লতে শুরু করলে ওরা জানলার দিকে চেপে আসে। ব্রড-গেজ ট্রেনের দ্বিতীয় বিভাগের সিট। প্রতিদুইটা সিট সামনা-সামনি বিন্যাসে বসানো। ওটা ওদের গল্প করার জন্য সুবিধাজনক হয়েছে। খুব অল্প সময়ের ভেতরেই ট্রেন খালিশপুর পেরিয়ে যায়। ট্রেনের জানলা দিয়ে দেখা খালিশপুরকে ওদের চেনা খালিশপুরের থেকে যেন বেশ অচেনা লাগে। নাবিলা বেশ মুগ্ধ হ’য়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে। কলির মনোযোগ যেন ট্রেনের বগির দিকে। সিটের উপর নিল-ডাউন হ’য়ে কলি হিসাব ক’রে নিতে চায় কতগুলো সিট ফাঁকা বগিতে।‘স্টেশনে তো অনেক লোক দেখলাম। অথচ ট্রেন তো ফাঁকা।’ কলি ওদেরকে জানালো।
‘এই বগিতে হয়তো ভীড় কম। অনেক মানুষ উঠতে দেখলাম তো।’
‘চল অন্য বগিগুলো ঘুরে দেখি।’ নাবিলা প্রস্তাব দেয়।
‘আগে চা খেয়ে নিই। সকালে চা খেতে পারিনি তড়িঘড়ির জন্য।’
‘চা নিয়ে কখন আসবে তার ঠিক আছে? চল ক্যান্টিন-কারের দিকে যাই।’
‘আর একটু দাড়া তো। আমি বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। বাবা বলেছে ট্রেন ছাড়ার মিনিট দশেকের ভেতরেই চা-নাস্তা নিয়ে আসার কথা।’ যুথির বাবার কথা ভুল হয় না। ওর কথা শেষ হওয়ার আগেই শাদা ইউনিফর্ম পরা দুই জনকে খাবারের ট্রে হাতে ওদের বগিতে ঢুকতে দেখা যায়।
একধরণের স্যান্ডউইচ আর মুরগীর মাংসভাজি কেনে ওরা। আর চায়ের অর্ডার করে। মাংসভাজিটা দেখতে খুব একটা ভালো না দেখালেও খেতে ওদের খারাপ লাগে না। এগুলো খেতে খেতেই ওদের চা চ’লে আসে। টি-ব্যাগের চা। রং-চা। বাসাতে ওদের সবারই দুধ-চা খাওয়ার অভ্যাস। পেয়ালাতে চুমুক দিয়ে নাবিলার একবার মনে হ’লো আর খাবে না। যুথির দিকে চেয়ে একবার বলেই ফেললো, ‘ইয়াক! এই জিনিস খাওয়া যায়?’ অথচ সেই বলাতেও যেন আনন্দের ছড়াছড়ি।‘এহ! আসছেন আমার লাট-সাহেবের বাচ্চারা! ট্রেনে আপনাদের জন্য দুধ দিয়ে চা বানানোর ব্যবস্থা রাখতে হবে! যা পাচ্ছিস তাই খা। খাবার নিয়ে এইসব ঝামেলা করলে আমি কিন্তু তোদেরকে চুয়াডাঙ্গা নিয়ে যাবো না ব’লে দিলাম।’ কলির শাসন বা হুমকিতে বেশ কাজ হয়। নাবিলা আর যুথি দুই জনই আবার চায়ে চুমুক দেয়।
প্রতিবার চুমুক দেয় আর কলিকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে, ‘ইয়াক!’ কলি প্রথম কয়েকবার সেটাকে প্রশ্রয় দেয় না। বাংকার থেকে ওর ব্যাগ নামিয়ে তা থেকে একটা অটো-ক্যামেরা বের করে। যুথি আর নাবিলার চায়ে চুমুক দেওযার ছবি তুলে রাখে।‘আর একবার ইয়াক বলেছিস তো মাইর খাবি।’
‘তুই নাবিলার সাথে মারামারি ক’রে পারবি না। ও তোকে থাবা দিলে দুই দিনের জন্য তোর কথা বন্ধ হ’য়ে যাবে।’
‘তাহলে আর কি করা… তুই মাইর খাবি। নাবিলা ব’ললেও তুই মাইর খাবি।’ শুনে নাবিলা হাসে আর শেষ চুমুকটা দিয়েই ব’লে ওঠে ‘ইয়াক!’
‘যা এবারের মতো মাফ করে দিলাম। পরের বার এমন করলে কিন্তু আর মাফ নেই।’ কলির কথায় একধরণের প্রশ্রয় আছে। ওরা তিনজনই একসাথে হেসে ওঠে।
নোয়াপাড়াতে এসে ট্রেনটা বেশ ধীরে আগাতে থাকে। পরপর দুইটা দাড়িয়ে থাকা মালগাড়িকে পার হয় ওদের ট্রেনটা। কলি আর নাবিলা দ্বিতীয় মালগাড়িটার বগি গুনতে শুরু করে। বগিগুলোতে কয়লা, পাথর আর বস্তাবন্দি কিছু আছে। যুথিই প্রশ্ন করে, ‘বস্তাগুলোতে কী?’‘কি জানি কী? দেখে তো বোঝা যায় না।’ নাবিলা উত্তর দেয়।
অন্যপাশের সিট থেকে একজন বয়স্কলোক উত্তর দেয় নিজে থেকেই। ‘বস্তাতে বিভিন্ন ধরণের সার।’ শুনে ওরা তিনজনই কাঁচাপাকা দাড়ির লোকটার দিকে তাকায়। চোখে বড়-ফ্রেমের চশমা। ওদের তাকানো দেখে ওরা কোথায় যাবে সেটা জানতে চায় লোকটা।‘আমরা যশোর যাবো। আপনি?’ নাবিলা কথা ব’লে লোকটার সাথে।
‘ইশ্বরদি নামবো আমি।’
‘নিয়মিত যাতায়াত করেন এই রুটে?’
‘তা ব’লতে পারেন, মাসে ২/৩ বার।’ তারপর একটু থেমে বলে, ‘আপনারা নতুন মনে হচ্ছে।’
‘অনেকদিন পর দাদাবাড়ি যাচ্ছি। আগে মাঝেমাঝেই যাওয়া হ’তো।’ যুথি জানায়।
কিছুক্ষণ পর কলি অন্য বগিগুলো ঘুরে দেখার কথা জানায় ওদেরকে। কিন্তু ব্যাগগুলো রেখে যাওয়া আবার ঠিক হবে না। নাবিলা আর কলি প্রথমে যাবে ঠিক করে, আর যুথি ব’সে ব’সে ব্যাগগুলো পাহারা দেবে।
ট্রেনের এক বগি থেকে আর এক বগিতে যাওয়ার জায়গাটা বেশ ভীতিকর। রেলগুলো অনেকদিনের পুরাতন, তার উপর রক্ষণাবেক্ষণের যথেষ্ট অভাব। তাই রেলগুলোর সাংযোগের জায়গাটা পেরোনোর সময় বগিতে একটা ঝাঁকি টের পাওয়া যায়। চলন্ত ট্রেনের এক বগি থেকে আর এক বগিতে যাওয়ার সময় নিচের রেল-লাইনের দিকে চোখ চ’লে যায় নাবিলার। যদিও এতটুকু ফাঁক দিয়ে নিচে পড়ে যাওয়ার কোনো কারণ নেই, তবুও মনের ভেতরে কেমন একটা ভয়ের স্রোত ব’য়ে যায়। মনে হয় পড়ে গেলেই টুকরো টুকরো শরীর। একটা অদ্ভুত গা-শিরশির করা অনুভূতি হয়। আবার দ্বিতীয় বগিটা পার হওয়ার পর ভয়টা অনেকটাই কেটে যায়।
ক্যান্টিন-কারটা বেশ মজার। একটা বগির অর্ধেকটা নিয়ে। খাবারে অবশ্য তেমন বাড়তি কিছু নেই। যেসব খাবার ফেরি ক’রে বগিতে বিক্রি হচ্ছিলো সেগুলো ছাড়া কয়েক ধরণের বিস্কুট আর চকলেট আছে শুধু। একটা ফ্রিজে কোকাকোলা দেখে কলি উৎসাহী হয়। নাবিলা আর কলি দুইটা কাচের বোতলের কোক খুলে একটা জানলার পাশে গিয়ে বসে। কলি একজনকে ডেকে ওদের একটা ছবি তুলে দিতে বলে। ফেরার সময় ওরা যুথির জন্য এক বোতল ঠাণ্ডা কোকাকোলা নিয়ে আসে। এসে দেখে যুথি একটা গল্পের বই খুলে বসেছে। মাহমুদুল হকের অনুর পাঠশালা।
(চলবে)