তিন দিন ধ’রে নিজের মতো ক’রে ভাবে রিমি। রাশেদ জামানের চিঠিগুলো নিয়ে। ভাবে বাবা এসব জানে কিনা। আবার বাবাকে জিজ্ঞেস করা ঠিক হবে কিনা। ভাইয়াটাও এখন ঢাকাতে নেই। ফোনে এসব নিয়ে একেবারেই কথা বলতে ইচ্ছা করে না। রিমি একদিন আবিরকে চিঠি তিনটা পড়তে দেয়।
চিঠি পড়া শেষ হ’লে আবির ঠিক বুঝে উঠতে পারে না কী বলবে। কিন্তু কিছু একটা যে বলা দরকার তাও মনে হ’তে থাকে। আবির চিঠিগুলো নিয়েই কথা বলা শুরু করে। ‘কোথায় পেলে এগুলো?’
- ‘মার আলমারিতে। মার কাপড়-চোপড়গুলো গুছাতে গিয়ে পেয়েছি। আমরা কেউই অন্য কারো আলমারিতে হাত দিতাম না। বাবা এসব জানে কিনা তাও জানি না। আমার এখন কী করা উচিৎ বলো তো।
- – ‘চিঠিগুলো পুড়িয়ে ফেলতে পারো। এখন তো আর এসবের কোনো মূল্য নেই। যাকে লেখা চিঠি সেই আর বেঁচে নেই।’
- – ‘তা করা যায়। তবে তোমার কী মনে হয় এটা পড়ে?’
- – ‘তোমার মায়ের সম্পর্কে?’
- – ‘মায়ের সম্পর্কে, আমার সম্পর্কে…’
- – ‘তোমার মাকে তো সামনাসামনি দেখিনি কখনো। তবে মানুষের জীবনে জটিলতা থাকে অনেক। শেষ পর্যন্ত মানুষ কী সিদ্ধান্ত নেয় সেটাই গুরুত্বপূর্ণ আমার কাছে। আমেরিকা ফেরার আগে নিশি ফুপু বলছিলো, যে মানুষের জীবনে কোনো ভুল নেই তা কোনো জীবনই না। আমাকে এয়ারপোর্টে যাওয়ার সময় গাড়িতে বসে বলেছেন জীবনে ছোট ছোট কিছু ভুল করতে আর প্রেমে পড়তে। আমি হেসেছি। এখন মনে হচ্ছে, ফুপু ঠিকই বলেছেন।’
- – ‘তোমার আমাকে নিয়ে কোনো দ্বিধা নেই তো? আমি তিনদিন অনেক ভেবেছি। সামনে কী করবো জানি না। তবে তোমাকে জানানো দরকার মনে করেছি। আমার মনে হয়েছে তোমাকে আমার এখন সবচেয়ে বেশি দরকার।
- – ‘ভালো করেছো। এবার চলো একটু রিকশা করে ঘুরি কোথাও। অনেক দিন তোমার হাত ধরাও হয় না।’
- – ‘চলো পুরান-ঢাকার দিকে যাই। কোনো একটা নদীর পাড়ে যেতে পারলে ভালো হতো।’
- – ‘কিন্তু সদরঘাট তো অনেক দূরে। গেলে ফিরতে অনেক রাত হ’য়ে যাবে। এরই মধ্যে ৬টার বেশি বেজে গেছে…’
- – ‘তাও বটে। তবে আর ওদিকে আজ গিয়ে কাজ নেই। কার্জন হলের দিকেই যাই চলো।’
রিকশা ক’রে কার্জন হল যায় ওরা। এই ভ্রমণটা খুব প্রিয় রিমির। ওর মনে পড়ে একবার আবিরের সাথে রিকশা করে এফ. রহমান হলের সামনে থেকে টিএসসি পর্যন্ত এসেছিলো। তখনো ওদের ভেতরে প্রেমের সম্পর্ক হয়নি। রিমি আবিরকে জিজ্ঞেস করে সেদিনের কথা ওর মনে আছে কিনা।
আবির জানায় যে ওর মনে আছে। ‘মনে আছে কারণ সেদিনই আমার মনে হয়েছিলো- এই মেয়েটা অদ্ভুত। এই মেয়েটার ভেতরে কিছু একটা আছে … মুগ্ধ করার মতো কিছু একটা। ’
- ‘সেই জন্য তখন কথা বলতে চেয়েছিলে আমার সাথে?’
- ‘হুম।’
- ‘তা হ’লে তো ফুপু বলার আগেই স্যার প্রেমে পড়েছেন দেখা যাচ্ছে!’ রিমির কথা শুনে আবির হাসতে থাকে।
- ‘তাই তো দেখি।’
- ‘আচ্ছা, মাকে বলেছো আমাদের কথা?’
- ‘না।’
- ‘কবে বলবে?’
- ‘তুমি চাইলে আজই ব’লতে পারি। তবে কথাটা সামনাসামনি বলতে চাই আমি। মা আমার বিয়ের কথা ভাবছে।’ কথাটা ব’লে আবির রিমিকে আড়চোখে দেখার চেষ্টা করে। যদিও অন্ধকারে রিমির অভিব্যক্তি কিছু বোঝা যায় না।
- ‘আমি কিন্তু এখন বিয়ে করতে চাই না। আগে লেখাপড়া শেষ হোক।’ তারপর খানিকটা থেমে ব’লে, ‘এই চিঠিগুলো পড়ার পর বিয়ে ব্যাপারটা নিয়েই মনের ভেতরে খচখচ করছে। তুমি কিছুদিন আমাকে বিয়ের কথা বোলো না তো, প্লিজ।’
- ‘আমি বিয়ের কথা বলছি না তো। কথায় কথায় চ’লে এলো। সরি।’
আবিরের কথায় রিমির মন ভালো হ’য়ে যায় ক্ষণিকের জন্য। কিন্তু সেই মন ভালো ব্যাপারটা বেশি সময় স্থায়ী হয় না। তোপখানা মোড় থেকে আবিরের বেবিট্যাক্সি নেয়ার পর থেকেই বিয়ের ব্যাপারটা রিমিকে ঘিরে ধরে। বাবা আর মায়ের সম্পর্ক নিয়ে জানার আগ্রহ বাড়ে রিমির। রিমি মনেমনে ঠিক ক’রে ফেলে যে ব্যাপারটা নিয়ে বাবাকে ও কোনো প্রশ্ন করবে না। পুরোনো বিষয় টেনে এনে বাবাকে কষ্ট দেওয়া ঠিক হবে না। কারণ হয়তো বাবা ব্যাপারটা জনতো। আবার হয়তো জানতো না।
যদি ব্যাপারটা বাবা জেনে থাকে তবে সেটা নিয়ে নিশ্চয় মায়ের সাথে তার কোনো একটা বোঝাপড়া হয়েছিলো। তা না হ’লে এতটা বছর এই দুইজন মানুষ একসাথে থাকতো না নিশ্চয়। আবার এমনও তো হ’তে পারে বাবা আসলে কিছুই জানে না এখনো। তবে কি সারাটা জীবন মা-কে ঠিক মতো না জেনেই ভালোবেসে গেলো বাবা? নাকি ভালোবাসতো না? দায়িত্ব পালনের মতো সংসার ক’রে গেলো এতদিন!?
রিমি আর ভাবতে পারে না। বা ভাবনা জড়িয়ে যায়। বাবা আর মায়ের লম্বা কোনো কথোপোকথন মনে করার চেষ্টা করে রিমি। কিন্তু মনে ক’রতে পারে না। খাবার টেবিলে বাবা খুব কম কথা বলে। সে আগেও, এখনো। তবে বসার ঘরে বাবার সাথে রিমি আর আশিকের অনেক কথা হ’তো এই কিছুদিন আগে পর্যন্তও। এমন বিষয় খুব কম আছে যা নিয়ে রিমি আর আশিক খাওয়ার পরে বসার ঘরে ব’সে বাবাকে প্রশ্ন করতো না। সেসব প্রশ্ন নিয়ে জহিরুদ্দিন সিরাজীকে কোনো দিন বিরক্ত হ’তে দেখা যায়নি। কোনো কোনো দিন প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে অনেক রাতও হ’য়ে যেতো। বাবা হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে হয়তো কোনো বইয়ের রেফারেন্স দিতো। রিমি বা আশিক দুইজনই সেসব নিয়ে পরে পড়ে দেখতো। তাতে প্রশ্ন যে কমতো তা নয়। বরং আরো বাড়তো। নতুন প্রশ্ন নিয়ে আবার বাবার সাথে বসতো দুই ভাইবোন। কিন্তু রিমির মাথায় কখনো আসেনি যে সেসব কথোপোকথনের সময় মা কখনো থাকতো না। আজ বড্ড মনে বাজছে রিমির, মা কেন তখন ওদের সাথে থাকতো না।
রিমির কেন যেন মনে হয় ফুপু হয়তো কিছু জানতে পারে। মেয়েরা অনেক কিছু মেয়েদেরকে বলে। অথবা মেয়েরা আনেক কিছু ধরতে পারে, যা ছেলেরা পারে না। এই যেমন আবির। রিমির ভেতরে যে কী ঝড় বয়ে যাচ্ছে তা কি আবির বুঝতে পেরেছে আজ? পারলে কি এমন সহজ হ’য়ে কথা বলতে পারতো! রিমির এক ধরণের অভিমান হয় আবিরের উপর। এত সিরিয়াস একটা বিষয় কেন আবির গুরুত্ব দিলো না? রাশেদ জামান যদি রিমির প্রকৃত বাবা হয় তবে কি আবির রিমিকে বিয়ে করতে রাজি হবে?
রিমির চোখে ঘুম আসে না এক ফোঁটা। কয়েকবার ঘড়ি দেখে অস্ট্রেলিয়ার সময় মেলায় মনে মনে। সিনথিয়া ফুপু কি এতক্ষণে উঠে পড়েছে? ফোনের রিসিভার সিনথিয়াই তোলে ‘হ্যালো।’
- ‘হ্যালো ফুপু! কেমন আছো?’
- ‘আমরা ভালো। তোমরা ঠিক আছো তো? মিয়াভাই ভালো আছে?’
- ‘বাবা ঘুমাচ্ছে। এখন তো অনেক রাত এখানে…।’ একটু থেমে রিমি বলে, ‘ফুপু, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?’
- ‘অবশ্যই, তবে তাড়াতাড়ি। অরিল উঠে পড়েছে।’
- ‘তুমি রাশেদ জামান নামের কাউকে চেনো?’ রিমির প্রশ্নে খানিকটা চমকে যায় সিনথিয়া। কী ব’লবে বুঝে উঠতেও পারে না। রিমি ঠিক বুঝতে পারে না লাইনটা কেটে গেলো কিনা। ‘হ্যালো, ফুপু…’
- ‘হ্যাঁ, চিনি।’ সিনথিয়া জানায়। ‘ঠিক মতো ব’ললে, চিনতাম। তোমার নানাবাড়ির ঐ দিকের মানুষ। হঠাৎ ওনার কথা কেন?’
- ‘ওনার কয়টা চিঠি পেয়েছি, মার কাছে লেখা…’
- ‘ও, তাই বলো। ভাবি একসময় অনেক চিঠি লিখতো। মিয়াভাইকে তো চাকরীর জন্য নানা জায়গায় থাকতে হ’তো। আবার ভাবির কলেজ ঢাকাতে। কিছু একটা নিয়ে ব্যস্তা থাকলে সময় কাটাতে সহজ হয়।’
- ‘ফুপু, আমি চিঠিগুলো পড়েছি।’ রিমির এই কথায় আর সিনথিয়া কিছু বলে না। ‘আচ্ছা, বাবা কিছু জানে এ নিয়ে?’ রিমি জানতে চায়।
- ‘সম্ববত না।’ কিছু ব’লবে না ব’লবে না ক’রেও সিনথিয়া ব’লে ফেলে। ‘আসলে আমিও বেশি কিছু জানি না। আবার অনেক দিন আগের কথা। খুব একটা মনেও নেই। তুমি এ নিয়ে বেশি ভেবো না। তুমি বরং এক কাজ করো। চিঠিগুলো আমাকে পাঠিয়ে দাও। আমি একটু প’ড়ে দেখি।’
পরদিন সরকারী ডাকে রিমি চিঠিগুলোর একটা কপি ফুপুর ঠিকানায় অস্ট্রেলিয়াতে পাঠিয়ে দেয়। রিমি মাঝে মাঝে ফোন দিয়ে খোঁজ নেয় ফুপুর কাছে চিঠি পৌছালো কিনা। কিন্তু প্রতিবারই ফুপু ওকে জানায় যে চিঠি এসে এখনো পৌঁছায়নি।
(চলবে)