কিছুদিন রিমির আচরণ ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না আবির। দেখা ক’রতে চাইলে প্রায়ই বলে ‘আজ না, আর একদিন।’ সেই আর একদিনও যে কবে তাও ঠিক ক’রে বলে না। এদিকে আবিরের ফ্লাইট আর দশ দিন পর। অনেক পিড়াপিড়ির পর রিমি আজ রাজি হ’য়েছে। ক্লাসের পর সাড়ে তিনটায় ক্যাম্পাসে এলে দেখা হবে, নয়তো নয়। আবির প্রথমে চিন্তায় প’ড়ে যায়। যদিও রিমিকে বলে যে ও আসবে সময় মতো। কিন্তু অফিস থেকে কি ব’লে বের হওয়া যায় সেটাই ভেবে বের করতে পারে না।
অফিসের সহকর্মী হাসিবুল কবিরের সাথে অবিরের বেশ জানাশোনো হ’য়েছে এই ক’দিনে। যদিও মার্কেটিঙের লোক। ফলে সবার সাথেই ভালো সম্পর্ক রেখে চলে কিনা তাই নিয়ে আবিরের মনে দ্বিধা কাজ করে ঠিকই। তবুও কি মনে ক’রে দুপুরের খাওয়ার সময় আবির ছুটির ব্যাপারটা নিয়ে হাসিবুলের সাথে কথা বলে। হাসিবুল জানতে চায় আবিরের রিপোর্টিং বস কে?
- ‘জুবায়েদ আলী স্যার।’
- ‘জুবায়েদ ভাই তো খুব ভালো লোক। কোনো চিন্তা না ক’রে ওনাকে সরাসরি ব’লে ফেলেন। আমার মনে হয় না ঝামেলা হবে।’
- ‘কিন্তু স্যারকে তো খুব সিরিয়াস মানুষ মনে হয়। তার উপর উনি মাত্র গত মাসেই জয়েন করেছেন আমাদের সেকশনে। কাজের বাইরে কখনো কোনো কথা ব’লতে দেখিনি ওনাকে এর মধ্যে।’
- ‘আমি ওনাকে অনেক দিন ধ’রে চিনি। ভয় পেয়েন না। দেখেন ব’ললেই হবে।’
হাসিবুলের কথায় ভরসা পেয়ে কিংবা আর মাত্র ৭ দিন চাকরীতে আছে এই চিন্তা ক’রে আবির মনে আর কোনো দ্বিধা রাখে না। সরাসরিই জুবাইদ আলীকে ব’লে ফেলে রিমির কথা। দেখা যায় জুবাইদ আলী আসলেই স্বজ্জন লোক। এক কথাতেই রাজি হ’য়ে গেছে। শুধু হাতে কোনো কাজ থকালে তা ওর সহকর্মী রায়হানকে বুঝিয়ে দিয়ে যেতে বলে।
আবিরের হাতে কোনো কাজ জমে নেই। তাই অফিসের টেবিলটা গুছিয়ে একটু পরই বেরিয়ে পড়ে রাস্তায়। শাহবাগ পৌঁছে দেখে হাতে তখনো কিছু সময় আছে। আবির একটা হলুদ গোলাপ কেনে রিমির জন্য। ফুল এখনো ফোটেনি। এক ধরণের নরম জালি দিয়ে কুড়িটাকে মুড়িয়ে রাখা। এটা খুলে পানিতে রাখলে নাকি সন্ধ্যার দিকে ফুল ফুটতে শুরু করবে। কুড়িটা বেশ বড়সড়। দেখতে খুব সতেজ আর তরতাজা মনে হয়।
ফুলটা রিমির খুব পছন্দ হয়। আবিরের হাত ধ’রে টেনে ওকে চায়ের দোকানে নিয়ে যায়। চায়ে চুমুক দিতে দিতে আবিরের মনে হয় আজ রিমির মনটা বেশ ভাল। কিংবা গত কয়েক দিনের দুর্ভাবনাটা যেন এখন আর ওর ভেতরে নেই।
- ‘জানো? আজ একটা নাম্বার পেয়েছি। রাশেদ জামানের। ঠিক করেছি আজ সন্ধ্যায়ই যোগাযোগ করবো। তুমি কী বলো?’
- ‘নাম্বার কোথায় পেলে?’
- ‘ফুপু দিয়েছেন। আমার চিঠির কপি পাওয়ার পর ফুপু অস্ট্রেলিয়াতে অনেক যোগাযোগ করেছেন বাংলাদেশি কমিউনিটিতে। আর ওখানকার কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে। রাশেদ জামান দুইটা বিশ্ববিদ্যালয়ের গেস্ট টিচার এখন।’
- ‘ফুপু ওনার সাথে কথা বলেছেন?’
- ‘হুম, বলেছেন।’ তারপর খানিকটা চুপ থেকে রিমি জিজ্ঞেস করে, ‘তোমার মাথায় এই প্রশ্ন এলো কেন?’
- ‘কোন প্রশ্ন?’ আবির জানতে চায়।
- ‘এই যে রাশেদ জামানের সাথে ফুপুর কথা হয়েছে কিনা।’
- ‘এমনিই। এমনও তো হ’তে পারে এই রাশেদ জামান সেই রাশেদ জামান নন।’
- ‘না, উনিই। ফুপু নিশ্চিত না হ’ল আমাকে ওনার নাম্বার দিতেন না।’
- ‘তা হ’লে আর চিন্তা কী! কথা ব’লে দেখো।’
কিন্তু বাসায় ফিরে রিমি কয়েক বার চেষ্টা ক’রেও সেই নাম্বারে কাউকে পায় না। প্রতিবারই রিং হয়, কিন্তু ফোনের রিসিভার তোলে না কেউ। রিমির মনে আবার সেই মনমরা ব্যাপারটা ফিরে আসে। খাবার টেবিলে সেটা জহিরুদ্দিন সিরাজীর নজর এ্যাড়ায় না। ‘কি রে মা! শরীর খারাপ?’
- ‘না, বাবা।’
- ‘তবে? তোকে কেমন যেন বিষন্ন দেখাচ্ছে! আমার ছেলে-মেয়েরা বিষন্ন থাকবে কেন?’ জহিরুদ্দিনের কন্ঠে রসিকতার সুর।
- ‘এমন কিছু না। ক্লাস ছিলো বিকাল পর্যন্ত আজ। তাই খানিকটা ক্লান্ত। খাওয়াদাওয়ার পর চা খেলে ঠিক হ’য়ে যাবে। তুমি যে রাতের বেলা কফি খাও, তোমার কখনো ঘুমের সমস্যা হয় না?’ উল্টো রিমি প্রশ্ন করে বাবাকে।
- ‘সে তো শুতে শুতে প্রায় দুইটা। কফি এতক্ষণ শরীরে এ্যাফেক্ট করে না।’
- ‘এত কফি খেয়ো না তো বাবা। তোমার তো বয়স হয়েছে।’
- ‘নাহ! কত আর বয়স! এখনো তো অবসরেই যায়নি। তারপর ওসব নিয়ে ভাবা যাবে।’
- ‘আচ্ছা বাবা, তোমার মার কথা মনে পড়ে?’
- ‘পড়ে। সবসময়ই পড়ে।’ তারপর একটু থেমে বলে, ‘ভেতরে ভেতরে যে এতটা অসুস্থ হ’য়ে গিয়েছিলো কে বলবে! আমাকেও কখনো কিছু বলেনি। আমি টেরও পাইনি। অদ্ভুত লাগে ভাবতে…’
- ‘আমারো অদ্ভুত লাগে। যে দিন হাসপাতালে নিতে হ’লো তার আগে সম্ভবত দুই দিন দেখেছি আগে আগে কলেজ থেকে চ’লে এসেছে। এখন মনে হয় প্রথম দিনই যদি মাকে ডাক্তারের কাছে যেতে ব’লতাম!’ ব’লে কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকে রিমি। জহিরুদ্দিনও আর কোনো কথা বলে না। বাকিটা খাওয়া একরকম চুপচাপই শেষ করে ওরা।
খাওয়া শেষ হ’লে জহিরুদ্দিন পড়ার ঘরে ঢুকে যায়। আর রিমি ওর নিজের ঘরে। একটা অদ্ভুত একাকিত্ব যেন রিমিকে ঘিরে ধরে। কেমন একটা দুর্বোধ্য অস্থিরতা আচ্ছন্ন ক’রে ফেলে ওকে। একবার মায়ের মুখটা ভেসে ওঠে তো পরক্ষণেই আবার তা ঝাপসা হ’য়ে আসে। কখন যে রিমির চোখ গলিয়ে পানি পড়তে শুরু করে তা ও নিজেই টের পায় না। একসময় ঘুমিয়ে পড়ে রিমি।
পরদিন খুব সকাল সকাল ঘুম ভাঙতেই আবিরের কথা মনে আসে। গতকাল আবিরকে ভর-দুপুরে ডেকে এনেও খুব বেশি কথা বলা হয়নি ওর সাথে। রিমি এগারোটার দিকে আবিরের অফিসে ফোনকল করে। এ্যাডমিনের আব্দুল গফুর ফোনটা ধরে। আব্দুল গফুর রিমিকে জানায় যে আবির বেশ আগেই অফিসের কোনো একটা কাজে বেরিয়ে গিয়েছে আজ। সাথে অফিসের আরো কয়েকজন ছিলো। সম্ভবত আজ আর অফিসে ফিরবে না।
আরো দুই দিন পর আবিরের সাথে রিমির দেখা হয়। আমেরিকা যাওয়ার আগে আবির কিছু কাপড়চোপড় কিনতে চায়। তার জন্য নিউ-এলিফ্যান্ট রোডে এসেছে আবির। রিমি ওর জন্য শার্ট বেছে দেয় দুইটা। আবিরের বেশ পছন্দ হয় শার্ট দুইটা। আবির রিমিকেও কিছু একটা কিনে দিতে চায়। কিন্তু তার জন্য নিউ-মার্কেটে যেতে হবে কিনা বুঝে উঠতে পারে না। ‘কি ভাবছো অত?’ রিমির চোখ এড়ায় না সেটা।
- ‘না, তেমন কিছু না। তোমাকে একটা শাড়ি দেওয়ার কথা ভাবছিলাম। কিন্তু এখানে কি শাড়ি পাওয়া যাবে?’
- ‘তাই?’
- ‘হুম।’ একটু টেনে বলে আবির। রিমির এটা খুব আপন আপন লাগে।
- ‘শাড়ি না, তুমি বরং আমাকে দুইটা টি-শার্ট কিনে দাও।’
- ‘কোত্থেকে কিনবে?’ জানতে চায় আবির।
- ‘নতুন একটা দোকান হয়েছে, নিত্য উপহার। দারুন কিছু গ্রাফিক্স করছে ওরা। আজিজ মার্কেটে। চলো দেখি।’
বেশ কয়েকটা টি-শার্ট পছন্দ হয় ওদের দুইজনের। আবির নিজের জন্যও দুইটা কিনে ফেলে। এরপর ওরা ঘুরতে বের হয় রিকশা ক’রে। ‘ইস, আমরা যদি প্রতিদিন এই রকম রিকশা ক’রে ঘুরতে ঘুরতে প্রেম করতে পারতাম!’ রিমি আবিরের হাত ধ’রে বলে।
- ‘মন্দ হ’তো না, কি বলো?’
- ‘আচ্ছা তোমার যাওয়ার আগে আমরা প্রতিদিন ঘুরতে বের হবো?’
- ‘বের হ’তে চাও?’
- ‘হুম চাই। পারবে আসতে প্রতিদিন?’
- ‘একবার বাড়ি যাবো। আগামী চার দিন পারবো। তারপর আপাতত ব’লতে পারছি না।’ শুনে একটু মন ভার হয় রিমির। মনে মনে ভাবতে থাকে, আবির কি আরো কিছু দিন থাকতে পারতো না ঢাকাতে! অন্তত ওর এই সময়টাতে। মায়ের চিঠিগুলোর কথা মাথায় আসে। মা কি পারতো না চিঠিগুলো নষ্ট ক’রে ফেলতে! মায়ের উপর, আবিরের উপর এক ধরণের অভিমান ফেনিয়ে উঠতে থাকে রিমির।
- ‘আবির, আমার খুব একা লাগে ইদানিং।’ কান্না কান্না কন্ঠে বলে রিমি। ‘কখনো কখনো মনে হয় তোমাকে জড়িয়ে ধ’রে বসে থাকি সারাক্ষণ। যাওয়ার আগে একদিন বাসায় আসবে? একদিন সারাদিন আমার সাথে থাকবে?’
- ‘বাবা?’
- ‘বাবা তো দিনে অফিসে থাকে। আর থাকলোই না হয় বাবা?’ রিমির গলায় আব্দারের সুর।
- ‘আমার সিডিউল তো জানো। বৃহস্পতিবার শেষ অফিস। ঐদিন শুধু রিপোর্টিং ব’লতে পারো। লাঞ্চের আগে আগে চ’লে আসতে পারবো। সেদিন হ’লে হবে?’
- ‘হবে।’ ছোট্ট করে বলে রিমি।
জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের লাউঞ্জে বসে আছে আবির। ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের একটা বিমানে ওর জার্নি শুরু হবে। রিমির কথা মনে প’ড়তে থাকে আবিরের। তিনদিন আগে আবিরের রিমিদের বাসায় যাওয়ার কথা ছিলো। কথা ছিলো আবির দুপুরের খাবারের আগেই পৌঁছে যাবে ওদের বাসায়। তারপর সন্ধ্যা পর্যন্ত রিমি আর আবির একসাথে কাটাবে। কিন্তু আবিরকে অফিস থেকে বিদায় জানানোর একটা আয়োজন করেছিলো ওর কলিগরা, জুবাইদ আলীর নির্দেশে। আবিদ আটকে গিয়েছিলো। রিমিদের বাসায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে আবিরের দুইটা বেজে যায়। রিমি আবিরকে বাসায় ঢুকতে দেয়নি। দারোয়ানের হাত দিয়ে একটা চিঠি পাঠিয়ে জানিয়েছিলো, আবির যেন আর কখনো ওর সাথে যোগাযোগ না করে।
(চলবে)