গত কয়েক দিন ধ’রেই তাহমিদ ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছে। ওর বন্ধুর বিয়ে, খুব ক’রে বলেছে ও যেন যায়। ওদের বন্ধুত্বের ভেতরে একটা সজীবতা আছে। সেটা সময়ের সাথে সাথে যেন আরো বেড়েছে। এটা ভাবলেই তাহমিদের মনে হয়- ওর যাওয়া উচিৎ।
তবুও ওর পক্ষে নিশ্চিত সিদ্ধান্তে পৌছানো সম্ভব হয় না। রিয়াজের সাথে যে বিয়ে হবে মিথিলার। মিথিলা ওর স্কুলের সহপাঠী। অনেক দিনের চেনা। আবার বলা যায় অনেক দিনের অচেনাও।
ওদের স্কুলটাতে ছিল কো-এডিকেশন। নিচের ক্লাসে থাকতেই ওদের ভেতর বেশ একটা বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। ওরা যখন ক্লাস নাইনে ওঠে তখন মিথিলারা নতুন বাসা ক’রে তাহমিদদের বাসার কাছাকাছি চ’লে আসে। তাতে ওদের বন্ধুত্বটা আরো গাঢ়ই হয়েছিল। কলেজে উঠে দুইজন দুই কলেজে চ’লে গেলেও তাই যোগাযোগটা ছিল।
তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির পর যখন দেখা গেল তাহমিদ আর মিথিলা একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাচ্ছে তখন মিথিলা একবার ঠাট্টা ক’রে তাহমিদকে বলেছিল, এই ছেলে তুমি তো দেখি আমার পিছুই ছাড়ছো না। ব’লে মিথিলা বেশ হেসেছিল। অথচ ঐ প্রথম বারের মতো তাহমিদ মিথিলার রসিকতাতে হাসতে পারেনি। সেই নিয়েও তাহমিদ আজকের মতো দোটানায় পড়েছিল।
বেশ কয়েক মাস ভেবে ভেবে আর নিজেকে প্রশ্ন ক’রে উত্তর পেয়েছিল তাহমিদ। ও মিথিলার প্রেমে পড়েছে। তখন ভাবতে বসেছিল মিথালাকে সেটা জানাবে কি জানাবে না সেটা নিয়ে। হয়তো একটু বেশিই ভাবনায় পেয়ে বসেছিল ওকে। হলের রুম-মেইট বজলু ঠিক বুঝেছিল ব্যাপারটা। তাহমিদকে জিজ্ঞেস করলে ও বজলুকে বলেছিল মিথিলার কথা, বলেছিল মিথিলার জন্য ওর অনুভূতির কথা। বজলু ওকে পরামর্শ দিয়েছিল মিথিলার সাথে সরাসরি কথা বলার।
তাহমিদ মিথিলার সাথে কথা বলেছিল এর কয়েকদিন পরই। মিথিলা খুব কঠিন একটা দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়েছিল তাহমিদের দিকে। হয়তো তাহমিদ ঠাট্টা করছে কিনা এটা বোঝার জন্য। সেদিন মিথালা কী বুঝেছিল তাহমিদ তা জানেনি কখনো। তাহমিদ শুধু জেনেছিল, মিথিলা চায় ও যেন আর কখনো ওর সামনে না আসে।
তাহমিদ আর কখনো ওর সামনে যায়নি। মিথিলাকে দেখলেও দূরে চ’লে যেতো। ছুটিতে বাসায় এলেও ওরা কখনো একসাথে আসেনি। বা কখনো একসাথে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেরেনি। এগুলো যে খুব অভিমান বা রাগের জন্য হয়েছে তা নয়। কিন্তু কেন যে হয়েছে তাও তাহমিদ জানে না। মাঝে মাঝে ভেবেছে। যদিও উত্তর পায়নি।
রিয়াজ তার বিয়ের খবরটা তাহমিদকে দিয়েছে গত সপ্তাহে। বেশ একটু নাটক ক’রেই দিয়েছিল খবরটা। ফোন ক’রে বলেছিল কোনো একটা ইন্টারেস্টিং খবর আছে নাকি তাহমিদের জন্য। সেটা দেওয়ার জন্য রিয়াজ উত্তরা থেকে আজিমপুরে এসেছিল। হয়তো বন্ধুকে সামনাসামনি ব’লতে চেয়েছিল ব’লেই এমনটা করেছিল রিয়াজ। মিথিলার সাথে তাহমিদের বিয়ে – এটা শুনে তাহমিদ খুশি হয়েছিল মিথিলার জন্য। রিয়াজ ভাল ছেলে। জানা-শোনাও ভাল। চাকরীতেও ভাল করছে। তাহমিদ রিয়াজকে অভিনন্দন জানিয়েছিল স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে।
বিয়েটা পারিবারিক ভাবে হচ্ছে। রিয়াজদের বাড়ি জামালপুর থেকে ওরা যাবে মেয়ের বাড়িতে। জামালপুর থেকে ঝিনাইদহে যাতায়াত করা খুব সহজ নয়। রিয়াজদের আয়োজন তাই খুব বড় নয়। দুইটা ১২ সিটের টয়োটা হায়েস নিয়ে ওরা যাবে বিয়ের দিন। নিজেদের লোক ১২/১৩ জনের মতো। তাহমিদদের বাসাও যেহেতু ঝিনাইদহে তাই রিয়াজের বিশেষ অনুরোধ তাহমিদের কাছে। অথচ তাহমিদ একবাক্যে রাজি হ’তে পারে না। আবার রাজি না হওয়ার কোনো কারণও ব’লতে পারে না।
তাহমিদ একবার ভাবে যাবে। আবার ভাবে যাবে না। কিন্তু পরদিন যখন মিথিলার মায়ের ফোন আসে তাহমিদের কাছে, তখন তাহমিদ ঠিক করে ও যাবে। পরে ও রিয়াজকে জানায় সেটা। তবে ও রিয়াজদের সাথে যাবে না। নিজের মতো ক’রে সব সময় যেভাবে বাড়িতে যায় সেভাবে যাবে। তারপর রিয়াজরা এলে ওদের সাথে দেখা করবে।
তাহমিদ একদিন আগে বাড়িতে যায়। বিশেষ কোনো কারণে নয়। মা-বাবা বোনের সাথে একটা দিন থাকা হবে এই ভাবনায়। সেদিন কোনো একটা কারণে মিথিলা তাহমিদদের বাসায় এসেছিল। ফেরার সময় ওর মা বলেছিল, যা তো বাবা মেয়েটাকে ওর বাড়িতে পৌছে দিয়ে আয়। তাহমিদ মিথিলার সাথে সাথে গিয়েছিল ওদের বাসা পর্যন্ত। সহজ স্বাভাবিক কিছু কথা হয়েছিল ওদের। মিথিলাকে ওদের বাসার গেটে বিদায় জানানোর সময় তাহমিদ হঠাৎ জানতে চেয়েছিল, তুমি আমার উপর রাগ রাখোনি তো?
মিথিলা আবার যেন ঠিক সে দিনের মতো ক’রে তাকিয়েছিল তাহমিদের দিকে। পরে একটু সহজ হ’য়ে ব’লেছিল, আমি ভেবেছিলাম তুমি আবার আসবে, আরো কিছু ব’লবে। অথচ তুমি আর কখনো কিছু বলোনি।
এরপর মিথিলার সাথে রিয়াজের বিয়ে হয়ে যায়। তাহমিদের সাথে ওদের আর যোগাযোগ থাকে না। ৬ মাস পর তাহমিদ জার্মানিতে চলে আসে আর একবার মাস্টার্স করার জন্য।
তাহমিদের মাস্টার্স যখন প্রায় শেষের দিকে তখন একদিন গভীর রাতে ওর কাছে একটা ফোন আসে। বাংলাদেশের ফোন কোড, তবে নাম্বারটা অপরিচিত। তাহমিদ ফোনটা ধ’রে হ্যালো বলে। মিথিলার ফোন। ও তাহমিদকে বলে, আমার মনে হয় আমি তোমাকে বিয়ে করলে অনেক সুখী হ’তাম।