গল্পটা হয়তো খুব বড় না। ১৮২৪ এ জন্ম নেয়া একজন মানুষের গল্প। ছেলেবেলার প্রথম কয়েক বছর যশোরের গ্রামের বাড়িতেই। একটু বড় হয়ে মায়ের হাত ধরে যেতে হয় কলকাতাতে যেখানে বাবা কাজ করেন। সেখানেই বসবাস আর লেখাপড়ার সাথে সাথে অন্যরকম হয়ে ওঠা। পরে বাবার পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করতে না চাওযার দরুন ধর্ম পরিবর্তন। তাই নিয়ে টানাপোড়েন। সাথে বড় কবি হয়ে ওঠার স্বপ্ন। স্বচ্ছল জীবনের ছন্দপতন। একসময় মাদ্রাসে যাওয়া বা পালানো। সেখানেই সত্যিকারের কবি বা লেখক হয়ে ওঠার চেষ্টা। সাথে বিয়ে সংসার। একজন শেতাঙ্গ।রেবেকা। চার সন্তারের বাবা হওয়া। টানাটানির সংসার যাপন।
সেখান থেকেও পালানো। বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর সম্পত্তির অধিকার নেয়ার যুদ্ধ। রেবেকার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করা। হেনরিয়েটার সাথে বিয়ে ছাড়া সংসার করা। সন্তানের পিতা হওয়া। পরপর তিনটি। এইসময়ে বাংলাতে লেখালেখির শুরু। শুরু ‘রত্নাবলী’ নাটকের ইংরেজি অনুবাদ দিয়ে হলেও দ্রুতই তিনি লিখে ফেলেন ‘শর্ম্মিষ্ঠা নাটক’। তারপর মাত্র চার বছরের মত সময়ে ‘মেঘনাদ বধ’এ পৌছে যাওয়া বা এই ধরণের ছোটখাট মহাকাব্য লিখে হাত পাকিয়ে নেয়ার চেষ্টা। কিন্তু ছোটখাট মহাকাব্যই যখন যশ এনে দিল তখন লেখালেখি প্রায় ছেড়েই দেয়া। তখন অন্য যশের পেছনে ছোটা। ব্যারিস্টার হতে হবে। তাই বিলেত যাত্রা। তার জন্যটাকাপয়সার যোগার যন্ত্র। সেখানে গিয়ে টাকপয়সার সংকটে পড়া। সেখানে হেনরিয়েটার আগমণ। তাই ফ্রান্সের ভার্সায় যাওয়া। ব্যারিস্টারি পড়া স্থগিত রেখে সেখানে থাকা। ইউরোপিয়ান কিছু ভাষা শেখা। ‘হেক্টর বধ’ অনুবাদ বা লেখা। পরে আবার বিলেতে ফিরে গিয়ে ব্যারিস্টারি পড়া শেষ করা। এই সময়ের মধ্যে বিদ্যাসাগরের দারস্থ হওয়া। টাকা-পয়সার জন্য।
ব্যারিস্টার হয়ে পসার করতে না পারা। উচ্চাভিলাসী জীবন যাপন। পরিণামে অর্থাভাব। নিজের এবং হেনরিয়েটার জীবন সংসয়কে এগিয়ে আনা। মৃত্যুর কয়েক সপ্তাহ আগে শর্মিষ্ঠার বিয়ে দেয়া। অথচ একসময় নিজে পিতার পছন্দে বিয়ে করেননি। সন্তানদের জন্য নিশ্চিত কোন ভবিষ্যৎ রেখে যেতে না পারা এক জীবন। কবি জীবন। ১৮৭৩ এ যার অবসান।
গল্পটা খুব ছোট হলেও সেখানে অনেক বাঁক। সময়ের ভূমিকাও কম নয়। ইংরেজি না জানা পিতা ছেলেকে শিখিয়েছেন ইংরেজি। সেই ছেলে একসময় সযতনে ভুলে যেতে চেয়েছিল বাংলা। নিজের কোন ছেলে-মেয়েকে কখনো বাংলা শেখানও নি। সেই তাকেই বলতে হয়েছে ‘ রেখ গো মা দাসের মনে…’ নিয়তিই এর নির্ণায়ক কিনা কে জানে?
এই গল্পের খুটিনাটি বের করে আনা সহজ কাজ ছিল না। অন্তত এতবছর আগের নথিপত্র, চিঠিপত্র সব যাচাই বাছাই করা চারটিখানি কথা না। তার উপর যশোর, কলকাতা, মাদ্রাস, লন্ডন, ভার্সায়,ঢাকা এতগুলো শহরে ছড়ানো যে গল্প।
গোলাম মুরশিদের ‘আশার ছলনে ভুলি’ আসলে সেই গল্প বের করে আনারই গল্প বলে মনে হয়েছে আমার কাছে। গোলাম মুরশিদের লেখা আমার ভাল লাগা শুরু করে তার ‘হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি’ পড়ার পর থেকেই। এরপর থেকেই আমি খুজতে থাকি এই লোকের লেখা অন্য বইগুলো। তেমন একটা সফল হয়নি আমার এই অভিযান। কারণ ওনার বইয়ের বেশ কিছু ভারত থেকে প্রকাশ হয়েছে। বেশ কিছু বোধহয় এখন ছাপার বাইরে। আর খুব বেশি সংখ্যায় বোধহয় প্রিন্টও হয়না।
আনন্দ থেকে প্রকাশ হওয়া ‘আশার ছলনে ভুলি’এর তৃতীয় সংস্করণ দুই দফায় মোট প্রিন্ট হয়েছে ২০০০ (২০০৮ সাল পর্যন্ত)কপি। আর তাই এই বই যোগাড় করাটা খুব সহজ হবে এটা বোধহয় না। তারপরও আমি যে এককপি যোগাড় করতে পেরেছি সেটা ভেবে ভাল লাগছে। কারণ? এইভাবে যে কারো জীবনী লেখা সম্ভব সেটা আমার ধারণাতেই ছিল না।
আমি নাহয় খুব সহজে বলে দিতে পারি… জাহাজে করে কলকাতা থেকে কবি মাদ্রাস গেলেন। সাথে হয়তো যাত্রার তারিখও উল্লেখ করলাম। কিন্তু কবি কোন জাহাজেগিয়েছিলেন? সেই জাহাজটা কি ধরণের জাহাজ? যেতে কতদিন লেগেছিল? জাহাজের যাত্রীতালিকাতে কবি কি নামে টিকেট করেছিলেন? এই সব খুটিনাটি এতবছর পরে খুজে বের করা আজকের দিনে আর কারো পক্ষে কি সম্ভব?
বিয়ে বা ব্যাপটিজমের ক্ষেত্রেও কি কম তথ্য যোগার করেছেন গোলাম মুরশিদ ? মাইকেলকে লেখা কোন চিঠি সংরক্ষিত নেই। তবে মাইকেলের লেখা বেশ কিছু চিঠিসংরক্ষণ করা গেছে। সেখানে আবার তারিখের উল্লেখ আছে কমটাতেই। তাই সেখান থেকে ঘটনার ধারাবাহিকতা ঠিক করা !! ব্যাপক পরিশ্রম সাধ্য কাজ। প্যাশন না থাকলেএটা করা সম্ভব হয় না। লেখকের এই প্যাশন পাঠককে মুগ্ধ করবেই। আবার হয়তো পাঠককে একেবারে সমর্পিত করতে বাধ্য করবে। আমার ক্ষেত্রে অনেকটা তাই হয়েছে।
এর আগে কোন লেখকের জীবনী পড়ার পর সেই সব লেখকের লেখা পড়ার আগ্রহ তৈরী হয়েছে সাধারণত। কিন্তু এইবার হল অন্য রকম। গোলাম মুরশিদের লেখা মাইকেলের লেখার সমালোচনা পড়ার আগ্রহ তৈরী হয়েছে।