পর্যাপ্ত আবাসন ব্যবস্থা গ’ড়ে তুলতে না পারলে তার পরিণতিতে সমাজে ক্ষোভ দানা বাঁধতে পারে ব’লে লি কর্বুজিয়ের একবার সতর্ক করেছিলেন। (১) এই পর্যাপ্ত ব্যাপারটা খুব নির্দিষ্ট ক’রে যে বলা যাবে তা হয়তো নয়। সমাজ, শহর, অর্থনীতি ভেদে এই পর্যাপ্ততার ব্যাপারটা ওঠানামা করে এবং করবে। বাংলাদেশের অর্থনীতি বেশ ধারাবাহিক ভাবেই বাড়ছে গত কয়েক দশক ধ’রে। তার পরিণতিতে দেশে ভালো মানের আবাসন ব্যবস্থার প্রয়োজনও বাড়ছে। দেশে ভবন নির্মাণের গড় গুণগত মান যে বাড়ছে তাতে সন্দেহ করার কোনো সুযোগ নেই। ফলে সুউচ্চ ভবন আমাদের কাছে বেশ পরিচিত হ’য়ে উঠতে শুরু করেছে। এমনকি সেটা ঢাকা শহরের বাইরেও।
সম্প্রতি সরকারী উদ্যোগে নতুন যে সব আবাসন ব্যবস্থা গ’ড়ে তোলা হচ্ছে তার অনেকগুলোর উচ্চতাই দশ তলার বেশি। এই আবাসন ব্যবস্থাগুলোর কিছু সরকারী কর্মচারীদের জন্য, ফলে বিক্রির জন্য নয়। অনেকগুলো জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে করছে, যেগুলো বিক্রির জন্য। সামরিক আর আধাসামরিক বাহিনীর জন্য নতুন ক’রে গ’ড়ে তোলা আবাসিক সুবিধাগুলোর অনেকগুলোই ১৪/১৫ তলার কাছাকাছি উচ্চতার।
ঢাকা আর চট্টগ্রামে এখন যে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা (ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ২০০৮) চালু আছে তাতে রাস্তা যদি তুলনামূলক প্রশস্ত হয় তবে তার পাশের জমিতে মোটামুটি ১৪ তলার আবাসিক ভবন তৈরীর অনুমতি পাওয়া যায়, যদি না জমির আকার নির্দিষ্ট কিছু পরিমাণের কম হয়। আবার একটু উল্টো ক’রে ব’ললে যেহেতু এ্যাপার্টমেন্ট ভবনের (এ-২ টাইপ ভবন) জন্য সর্বোচ্চ ফার (ফ্লোর এরিয়া রেশিও) ৬.৫ নির্ধারণ করা আছে, আর সে ক্ষেত্রে নিচতলা আর জামিনদোজ (বেইজমেন্ট) ব্যতীত অন্যান্য তলার জন্য জমির সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ জায়গা সীমাবদ্ধ করা আছে সেহেতু ১৪ তলার উপরে আবাসিক ভবন তৈরীর সুযোগ গিয়েছে কমে। যদিও চাইলে ভূমি-ব্যবহারের পরিমাণ কমিয়ে আরো উঁচু আবাসিক ভবন তৈরীর অনুমোদন নেওয়ার সুযোগ আছে, কিন্তু সেটা করতে ডিভেলপারদেরকে দেখা যায় না বললেই চলে। তার একটা কারণ অর্থনৈতিক আর একটা কারণ সিভিল-এ্যাভিয়েশন কর্তৃপক্ষের বেধে দেওয়া উচ্চতার সীমা, সেটা খুব কম ক্ষেত্রেই ১৫০ ফুটের বেশি হয়। ফলে ঢাকার বা চট্টগ্রামের আবাসিক ভবনের উচ্চতা ১৪ তলার ভেতরে সীমাবদ্ধ হ’য়ে পড়ছে; বাস্তব বিবেচনায়।
ওয়াল্ডএ্যাটলাস.কম এর অক্টোবর ০৪, ২০২০ এর একটা প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে জনঘনত্বের দিক দিয়ে পৃথিবীর শহরগুলোর মধ্যে ঢাকা বর্তমানে ষষ্ঠ অবস্থানে আছে। (২) এই প্রতিবেদনের মতে ঢাকাতে প্রতিবর্গকিলোমিটারে ২৯০৬৯ জন মানুষের বাস। আবার ওয়াল্ডোমিটারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী সিঙ্গাপুর সিটিতে প্রতিবর্গকিলোমিটারে বাস করে ৮৩৫৮ জন মানুষ। আর উইকিপিডিয়া জানাচ্ছে জন-ঘনত্বের বিবেচনায় চট্টগ্রামের অবস্থান ৫৫ তম। (৩) সেখানে প্রতিবর্গকিলোমিটারে বাস করে ১৬৬৬১ জন মানুষ।
জন-ঘনত্বের সাথে শহরের ভবনগুলোর উচ্চতার একটা সম্পর্ক নিশ্চয় থাকে। সেটা শুধু ছবি দেখে হয়তো নিশ্চিত করা যাবে না। তার জন্য যথাযত সমীক্ষা হওয়া দরকার। শুধু ছবি দেখে যেটা বলা যায় তা হ’লো সিঙ্গাপুর-সিটি বা হংকং এর সাপেক্ষে ঢাকা বা চট্টগ্রামের ভবনের উচ্চতা বেশ কম। যেহেতু অধিক উঁচু ভবনের নির্মাণ-খরচ মাঝারি-উঁচু ভবনের তুলনায় কম সেহেতু আশা করা যায় ঢাকা বা চট্টগ্রামের আবাসিক ভবনের নির্মাণ-খরচ সিঙ্গাপুর কিংবা হংকং এর সুউচ্চ আবাসিক ভবনের অনুপাতে কম।
কিন্তু নির্মাণ-খরচ কম হ’লেই যে সেটা এ্যাফোর্ডেবল হবে তার নিশ্চয়তা নেই। কারণ তার সাথে অনেক সামাজিক আর অর্থনৈতিক সূচক জড়িত। গড় হিসাবে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় কম হ’লে তাদের পক্ষে অনেক কম-দামী জিনিসও কেনা সম্ভব নাও হ’তে পারে। প্রাপ্ত তথ্য ব’লছে সিঙ্গাপুরের ৯০ শতাংশের বেশি লোকজনের এ্যাপার্টমেন্টের মালিকানা আছে। ঢাকার জন্য এমন তথ্য বা পরিসংখ্যান খুঁজে পাওয়া কঠিন। অল্প কিছু নমুনা যোগাড় করার চেষ্টা করেছি। কিছু বিল্ডিং পেয়েছি যার মালিক কোনো একক ব্যক্তি। নিজে একটা এ্যাপার্টমেন্টে থাকেন। বাকিগুলো ভাড়া দেন। কিছু বিল্ডিং পেয়েছি যার মালিকানা কয়েকজন আত্মীয়ের মধ্যে ভাগ করা। কেউ কেউ নিজেই থাকেন, কেউ কেউ ভাড়া দেন। বেশ কিছু বিল্ডিং ডিভেলপারের বানানো। তার কিছু এ্যাপার্টমেন্টের মালিক ল্যান্ডওনার। বাকিগুলো যারা কিনেছেন তারা কেউ একটা কিনেছেন কেউ বা একাধিক। অনেকেই এ্যাপার্টমেন্ট কিনে ভাড়া দিয়েছেন। কেউ কেউ নিজেই থাকছেন। ব্যক্তিগতভাবে ধানমন্ডি, মোহম্মদপুর, শ্যামলী আর মিরপুরের মোট ২২টা আবাসিক বিল্ডিঙের সমীক্ষা করে তার ৭২% এ্যাপার্টমেন্ট পেয়েছি যেগুলো ভাড়া নেওয়া। এই নমুনা সমীক্ষাকে স্ট্যানডার্ড হিসেবে নেওয়ার সুযোগ নেই। তবু বলা যায় যে ঢাকাতে নিজেদের মালিকানায় থাকার জায়গার সংস্থান আছে এমন মানুষের সংখ্যা ঢাকার মোট জনসংখ্যার ৪০% এর বেশি হওয়ার সম্ভাবনা বেশ কম।
বাসগৃহের মালিকানার সাথে শহরের জন-ঘনত্ব আর লিভিং-স্ট্যানডার্ডের বেশ সম্পর্ক আছে। শহরের জন-ঘনত্বের সাথে অর্থনৈতিক সক্ষমতাও নিবিড়ভাবে জড়িত। সামান্য কিছু তুলনামূলক তথ্য সংগ্রহ ক’রে আর তা হিসাব ক’রে পেয়েছি যে ধানমন্ডি আর গুলশানের জন-ঘনত্ব মিরপুর আর মোহম্মদপুর থেকে অনেক কম। অথচ ধানমন্ডি আর গুলশানের বিল্ডিংগুলোর গড় উচ্চতা বেশি। সুনির্দিষ্ট উপাত্ত তৈরী না ক’রেও বলা যায় যে জন-প্রতি অনেক বেশি বর্গফুট জায়গা ব্যবহার করে গুলশান, ধানমন্ডি আর উত্তরার বাসিন্দারা মিরপুর, মোহম্মদপুর কিংবা করাইল বস্তির বাসিন্দাদের অনুপাতে।
বাংলাদেশের একজন মানুষের মোটামুটি মানের আধুনিক জীবনযাত্রা নির্বাহ করার জন্য ঠিক কত বর্গফুট জায়গা দরকার তার কোনো সরকারী উপাত্ত কিংবা দিকনির্দেশনা দেই। জাতীয় আবাসন নীতিমালাতে এই ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তাভাবনাও নেই। এই ২০২০ এ দেশের মানুষ-প্রতি কত বর্গফুট জায়গা তার থাকার জন্য স্থায়ী অবকাঠামোতে আছে তার কোনো তথ্য-উপাত্তও এই মুহূর্তে আমাদের হাতে নেই। ফলে আমাদের হাতে থাকা জন-ঘনত্বের পরিসংখ্যানটা শহরের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার জন্য ব্যবহার উপযোগী নয়।
আবার কোনো একটা স্থানের জন-ঘনত্বের সাথে সেই স্থানের প্রাকৃতিক কিছু বৈশিষ্টও সম্পর্কিত। ঐতিহাসিক ভাবেই ঢাকা এবং তার আশপাশের কিছু এলাকার জন-ঘনত্ব বেশি। সীমানা আরো একটু প্রসারিত ক’রে দেখলে দেখা যায় বাংলা ব-দ্বীপ অঞ্চলে মানুষের জন-ঘনত্ব তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল থেকে বেশিরভাগ সময়ই বেশি ছিলো। এই তথ্য থেকে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে প্রাকৃতিক ভাবেই এই অঞ্চলের ভূ-প্রকৃতির এমন কিছু বৈশিষ্ট্য আছে যা অধিক সংখ্যক মানুষের বসতিকে ধারণ করতে পারে। তবে এই অধিক-সংখ্যক ব্যাপারটার নিশ্চয় একটা সীমা আছে। ঠিক কত সংখ্যক মানুষকে আজকের পরিস্থিতিকে ঢাকা শহরে স্বাস্থকর উপায়ে বসবাস করানোর ব্যবস্থা করা সম্ভব তা নিয়ে ব্যাপক গবেষণা করা দরকার। সেটা না ক’রে শুধু বাজারের চাহিদার উপর নির্ভর ক’রে এই শহরের বাসযোগ্যতার মান বাড়ানো নিকট ভবিষ্যতে সম্ভব হওয়ার সুযোগ বেশ সীমিত।
ঢাকার অধিক জন-ঘনত্বের অন্যতম প্রধান কারণ অর্থনৈতিক। এবং দরিদ্র মানুষই মূলত অল্পপরিসরে আটোসাটো পরিবেশে বসবাস করে। ফলে অর্থনৈতিক উন্নতি জন-ঘনত্ব কমিয়ে আনার একটা কার্যকর উপায় হ’তে পারে।
টিকা ও সূত্র:
১. if society would fail to produce and provide adequate housing to its members, there would be social unrest and agitation. লি কর্বুজিয়ের
২. https://www.worldatlas.com/articles/the-world-s-most-densely-populated-cities.html
৩. https://en.wikipedia.org/wiki/List_of_cities_proper_by_population_density
পুনশ্চ:
১. এ্যাফোর্ডেবল এর প্রচলিত বাংলা যদিও সাশ্রয়ী তবুও এটা সঠিক কিনা বলা শক্ত। কিনতে পারার সক্ষমতা শুধু মাত্র কম মূল্যমানের উপর নির্ভর করে না।
২. সচলায়তনের জন্য লেখা। এখানে সংরক্ষণ করলাম
http://www.sachalayatan.com/guest_writer/57909